মৃত্যুকালীন জবানবন্দি — সত্য ঘটনা অবলম্বনে ছোটোগল্প

avatar

ঝিঁঝিঁডাকা আঁধারকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে দলবেধে পাল্লা দিয়ে ডাকা বিলের পাশের ব্যাংগুলো। প্রায় ৮০ বছরের পুরানো বাঁশঝাড়ের পাশে নতুনকরে বাধানো কাচারিঘরে ঈমামসাহেব তালিম দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের। ব্যাং আর ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সুরেলা তিলাওয়াত। মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ডাকছে গোয়াল থেকে রহিম ব্যাপারীর রহিম ব্যাপারীর গাইদুটো।

সন্ধ্যার পর ঠিক নিয়মমাফিক ভাবেই বিদ্যুৎ ফাকি দিয়ে চলে গেছে। কুপির আলোয় হারিকেনে কেরোসিন দিচ্ছেন ইলিয়াস মেম্বর। মেজাজ তার অসম্ভব খারাপ। ফোরকান আলীর সাথে জমির মোকাদ্দমার কোন কুলই পাচ্ছেননা। ফোরকান বেশ টাকা খরচ করছে এই বিষয়ে। উকিল সাহেবের হাবভাবও ভাল ঠেকছে না তার। কোন ভাবে মামলার একটা গতি করা গেলে, বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে যাবে ইলিয়াস মেম্বর! এমন সময়ই দরজার সামনে এসে কারা যেনো ডাক দিল, "ইলিয়াস কাকা, বাড়ি আছেন নি!"

বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রনি, নিয়াজ। বিশাল করে সালাম দিল ওরা। তারপর তড়িঘড়ি করে কী কী জানি বললো। যার মূল কথা হচ্ছে ওরা দেখেছে, কে বা কারা যেনো ইলিয়াস সাহেবের দিঘিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। শুনেই ঘরে ফিরেই ডাবল ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে ওদের সাথে নিয়ে দিঘির দিকে রওনা দিল ইলিয়াস মেম্বর। পোনা ছাড়তে না ছাড়তেই মাছগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে পোলাপাইন।

বাঁশঝাড়ের কাছে এসেই ইলিয়াসের দেখা পেলো রহিমের। ইলিয়াসকে দেখে হাতের সিগারেটে একটা টান দিয়ে ফেলে দিল রহিম। রাগে গা টা কটমট করতে লাগলো ইলিয়াসের। ক'দিন আগেই সালিশ করে নিজ হাতে বেতিয়েছেন এই তিনজনকেই। অথচ কতবড় আস্পর্ধা এদের। একদম তাকে দেখেই সিগারেটে টান'টা দিয়েই ধুয়া ছাড়লো! পরে দেখা যাবে ভেবে, না দেখার ভান করে পা চালালো ইলিয়াস।

চাদরের নিচে শক্ত করে রামদা টা ধরে আছে রনি। সেদিন সালিশের মুহুর্তগুলি মাথায় আসছে বারবার। রনির বাপ এসে হাতজোড় করে মিনতি করেছিলো! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে দেখলো নিয়াজ পিছন থেকে একদম ইলিয়াস মেম্ববের ঘাড়ের মাঝে ট্যাডা বসিয়ে দিল! গো গো শব্দ করছে ইলিয়াস। রহিম বাশঝাড়ের ভেতর থেকে একটা চাপাতি বের করে কেমন করে যেন হাত (চাকু) চালাচ্ছে। রক্তের ছিটা মুখে এসে লাগছে রনির। পা কাপছে, শরীর টা ভারী-ভারী লাগছে, পিঠে কেমন জানি শীতল স্রোত বইছে। হঠাৎ কানে এলো "হালার পোলা!! দৌড়া মাদারি"

হাসপাতালে ডাক্তার নার্স ছোটাছুটি করছে ইলিয়াস মেম্বরকে নিয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট হাজির। ইলিয়াস সাহেব কিছুই দেখতে পারছেন না চোখে। জামাটা পুরো ভিজে যাচ্ছে শুধু এটাই বুঝতে পারছেন। ম্যাজিস্ট্রেট কি জিজ্ঞেস করলো বুঝতে পারলো না ইলিয়াস মেম্বর। শুধু বললো "বেজন্মা ফোরকান দুই বিঘা জমির লাইগা আমারে এমনে কুপাইলো!"

নতুন দিন আর দেখা হলো না ইলিয়াস মেম্বরের। ফজরের আজানের সময় বাধভাঙ্গা মরাকান্না জুড়ে দিল ইলিয়াসের স্ত্রী ও মেয়ে। ঠিক সেইসময়ই ফোরকান সাহেবের ঘুম ভাংলো পুলিশের ডাকে।


ম্যাজিস্ট্রেট এসেছিলো আহত/মৃতপ্রায় ব্যাক্তির জবানবন্দি নিতে। মুমূর্ষু-আহত কোনো মানুষ যদি তার মৃত্যুশয্যায় কোন জবানাবন্দি দিয়ে যায়, আমাদের দেশের মান্ধাতার আমলের আইনানুযায়ী সেই জবানবন্দি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয় (ধারা ৩২, সাক্ষ্য আইন - ১৮৭২) । বলা যায়, একটু ঘাঘু উকিল থাকলে এই মৃত্যুকালীন জবানবন্দির ফাঁদ থেকে বাচার উপায় থাকে না। ইলিয়াস মেম্বরের জীবন কেটেছে কোর্টের দোরগোড়ায়। মামলা-মোকাদ্দমাতে তার অসীম জ্ঞ্যান। দুই বিঘা জমি নিয়ে ফোরকানের বিরুদ্ধে মামলা করে অনেকদিন ঘুরছেন কোর্টে। কিন্তু মারা যাবার আগে, একটা বিশাল দাও মেরে দিলেন তিনি। নির্দোষ একটা মানুষকে জেল/ফাসি তো দিলেনই, ছেলেমেয়েদের সম্পত্তির ভাগ বারইয়ে দিলেন।

— মৃত্যুকালীন জবানবন্দি



0
0
0.000
5 comments
avatar
(Edited)

এতো দেখি হিমুর বড়মামা।😅

সত্য ঘটনা অবলম্বনে

মানুষজন মারা যাওয়ার সময়ও এরকম কাজ করে যেতে পারে।

0
0
0.000
avatar

ভাই আসলেই পারে, এবং করে । আমি আইন পড়ছিতো তাই অনেক কেস পড়ছি এমন। আর এর উপর আমার থিসিস করছিলাম ।

0
0
0.000
avatar

আসলেই মানুষ এই রকম কত কাজ করে। ভুয়া রেপ, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা; কি নাই। আর আমাদের যে বিচার ব্যবস্থা, জীবনেও সত্যি সামনে আসে না কিছু কিছু ক্ষেত্রে।

0
0
0.000
avatar

ভাই আমি একটা কেসের কাহিনী বলি। মানিকগঞ্জে দিনের আলোতে রাস্তার মাঝে একজনকে কোপায়ে চলে গেছে একদল সন্ত্রাসী। এক ভ্যানও্যালা তারে নিজের ভ্যানে নিয়ে হাসপাতালে দিয়ে আসছে। কেউ আগায়ে আসে নাই। সেই ভ্যানও্যালা এখনও যাবত জীবন কাটাচ্ছে জেলে। ভিক্টীমের পরিবার নিজে বলে গেছে যে ওই ভ্যানও্যালার কোন দোষ নাই, তাও !

0
0
0.000
avatar

জাস্টিস! মানুষের আফসোসের বাতাসে ভারি।
দুর্নীতি কমাতে না পারলে সামনে আরো খারাপ দিন আসবে।

0
0
0.000