"ডিজিটাল তাল গাছ"

avatar
(Edited)

খুব ব্যস্তাতার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে বাবলু সাহেবের। যান্ত্রিকতা জীবনটাকে যেন রোবোটিক জীবনে পরিনত করেছে। আজকাল আর পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে না, ভাঙ্গবে কিভাবে? পাখির ডাকতো শোনাই যায় না, ইটের দেয়ালের ভিতরে বাস করে। পাখির ডাক শুনতে হলে ইউিটিউব এ পাখির ডাক লিখে ভিডিও খুজতে হয়। পাখিদের কষ্টটা অনেকাংশে লাঘব করেছে মুঠোফোন নামের যন্ত্রটি। পাখিদের আজকাল আর ভোর হলে কষ্ট করে ডাকা ডাকি এবং গান গেয়ে মনুষ্য জাতির ঘুম ভাঙ্গাতে হয় না। মনুষ্যজাতির ঘুম ভাঙ্গানোর গুরুদায়িত্বটা পড়েছে মুঠোফোন নামের সেই যন্ত্রটির উপর। প্রত্যহ সকালবেলা বিছানায় কম্পন ধরিয়ে, ক্ষুদার্থ মানব শিশুর ন্যায় "টোয়াও টোয়াও" করে চিৎকার করে কেঁদে উঠে,ঘুমের বারটা বাজিয়ে জাগিয়ে তোলার মহতী দায়িত্বে কর্মরত হাজার হাজার ব্রান্ডের মুঠোফোন।

IMG_20200902_101209.jpg

বাবলু সাহেবের মুঠোফোন ও বাবলু সাহেবের ঘুম ভাঙ্গানোর দায়িত্বটা কাধে নিয়েছেন। ডিজিটাল যুগে স্ত্রীদের, স্বামীর আগে ঘুম থেকে ওঠা নাকি দন্ডনীয় অপরাধ। বাবলু সাহেবের স্ত্রী বাবলু সাহেবকে বাসর রাতেই এই কথা বলেছিলেন। স্বামী যদি অফিসে নাস্তা করে যাবার জন্য, নাস্তা তৈরীর নিমিত্তে, স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, তাহলে নারীদের বিশেষ ট্রাইবুনালের বিধান অনুযায়ী, উক্ত স্বামীকে সাত বছর, তার বিবাহিত স্ত্রীকে আটার রুটি তৈরী করে খাওয়াতে হবে। এই আইনটি নাকি আন্তর্জাতিক নারী শক্তি দ্বারা ঘোষিত। তাইতো বাবলু সাহেবের বিয়ের পর থেকে এখন অবধি বউয়ের হাতের সকালের নাস্তা জোটে নাই।

ইন্টারনেটে নাকি সবকিছুর তথ্য খুজে পাওয়া যায়, বউয়ের দ্বারা বাসর রাতে বিবৃত "নারী সকালের নাস্তা আইন" এর বর্ননা বাবলু সাহেব ইন্টারনেটের কোথাও খুঁজে পান নাই অনেক খোঁজা খোঁজির পড়েও। তাই ইন্টারনেটের প্রতি আস্তা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। হাজার হলেও বউতো আর স্বামীর কাছে মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। বউয়ের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস, তাইতো বউয়ের কথায় নিজের পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের ছেড়ে, দালানকোঠায় বসবাস করছেন। আধুনিক যুগ যাকে নিউক্লিয়ার পরিবার বলে।

IMG_20200902_101148.jpg

যাই হোক এখন কাজের কথায় আসা যাক, ওই যে প্রথমে বলেছিলাম খুব ব্যস্তার মধ্যে দিন কাটছে বাবলু সাহেবের, সেই ব্যস্তার কারন জানেন কি? বাবলু সাহেবের অফিসের বস, বাবলু সাহেবের উপর রেগে গিয়ে বলেছিলেন, কোন বস্তির মধ্যে বড় হয়েছেন আপনি, বস্তির লোকেদের মতো ব্যবহার আপনার। আধুনিকতার বিন্দু মাত্র ছিটাফোঁটা নেই আপনার মাঝে। বস বাবলু সাহেবকে তিরস্কার করেছেন, তাতে বিন্দু মাত্র আক্ষেপ নাই তার। কিন্তু বস তার জন্মভূমি গ্রামকে বস্তি বলছেন, এটা বাবলু সাহেব কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।

কবির কবিতার চেয়েও অপরুপ সুন্দর যে গ্রামে তার জন্ম, প্রায় একযুগ থেকে সেখানে যাওয়া হয় না। গ্রামের জন্য সর্বদাই তার মনটা খুব আনচান করে। গ্রামের শেস প্রান্ত দিয়ে একে বেকে চলা ছোট্ট নদীটিতে কতোদিন গোসল করা হয়নি তার। নদী থেকে সামন্য দুরেই সারি সারি তাল গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। তাল গাছের সারির একটু দুরেই বাবলু সাহেবের গ্রাম। কবি মনে হয়, তার গ্রামকে দেখেই বিখ্যাত সেই কবিতা "ঐ দেখা যায় তাল গাছ,ঔই আমাদের গাঁ,ঔইখানেতে বাস করে কানা বগির ছাঁ" লিখেছিলেন।

IMG_20200902_101828.jpg

সভ্যতার বিকাশে জয় জয়কার আধুনিক যুগের শহুরে মানুষগুলো আদো সভ্য কিনা তা নিয়ে দারুন দ্বিধায় বাবলু সাহেব। ইংরেজ সাহেবদের মতো সুট বুট পরিধান করলেই যদি সভ্য হওয়া যেত, তাহলে খলিফা সমাজ শুধু সুট আর প্যান্টেই সিলাই করতেন। অন্যকোন কাপড় সিলাই করতেন না। বাবলু সাহেবের বসের কথাই ধরুন না, বাবলু সাহেব সেদিন, তার ফুল প্যান্টের ভিতরে, শার্টের শেষ অংশটুকু গুজতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাইতো বস তাকে বস্তিতে বেড়ে ওঠা মানব সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বসের কথা মনে পড়তেই বাবলু সাহেব আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার কুড়ি হাজার টাকা দামের মুঠোফোন নিয়ে। গত রাতে তিনি ইউটিউবে সার্চ দিয়ে এটা আবিষ্কার করেছেন যে, গুগল ম্যাপস নামক মোবাইল অ্যাপস দিয়ে, ঢাকায় থেকে তার গ্রামকে দেখা যাবে। কালকে রাতেই বাবলু সাহেব তার মোবাইলে গুগল ম্যাপস অ্যাপসটি সেট করে নিয়েছিলেন। অ্যাপসের মাধ্যমে নিজের গ্রাম খুজতে খুজতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝতে পারেন নাই। আজকে যে করেই হোক তার নিজের গ্রামকে খুজে বের করে বসকে দেখাতে হবে, তিনি কোন বস্তিতে জন্মগ্রহন করেন নাই। তিনি রূপকথার চেয়েও সুন্দর গ্রামে হেসে খেলে বড় হয়েছেন।

IMG_20200902_101247.jpg

দীর্ঘ দুই ঘন্টা চেষ্টা করার পর, গাইবান্ধা জেলার, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার, জরমনদী গ্রামেকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তিনি মারাত্মক চিন্তায় পড়ে গেলেন। উক্ত ঠিকানা থেকে তার জন্মস্থান গ্রামটি কোথাও উধাও হয়ে গেছে নাকি ঘূর্নিঝড়ে? কিন্তু টিভিতে তো তিনি বিগত কয়েক বছরে এমন খবর শোনেন নাই। অনেক আগে শুনেছিলেন ঘূর্নিঝড়ে একটা বাঁশঝাড় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চলে গিয়েছিল, কিন্তু কোন গ্রামের কথা তিনি শোনেন নাই। তাহলে কি হয়েছে তার গ্রামের সাথে, কি হয়েছে একেঁবেকেঁ চলা সেই ছোট্ট নদীটার সাথে, কি হয়ছে সেই সারি সারি তাল গাছ গুলোর সাথে।

বাবলু সাহেব জুম করে করে খুব ভালো ভাবে তার গ্রামটাকে চেনার চেষ্টা করছেন গুগল ম্যাপসএ। হঠাৎ করে একটা পিচঢালা রাস্তার পাশে মৃত তালগাছ দেখতে পেয়ে তার রক্তচলাচলের গতি বহুগুনে বৃদ্ধি পেল। নদীটার অস্তিত্ব কিছুটা বোঝা যাচ্ছিল। হঠাৎ করে যে জায়গাটায় তাল গাছগুলো দাড়িয়ে থাকার কথা সেই জায়গাটাকে আন্দাজ করতে পারলেন তিনি। সেখানে উচু উচু কিছু একটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। বাবলু সাহেবর মনটা আনন্দে নেচে উঠল ঔতো তাল গাছ দেখা যায় বলে অফিসের মধ্যেই চিৎকার করে উঠলেন। চিৎকার শুনে দুইজন সহকর্মী তার কাছে এগিয়ে এলেন, বাবলু সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে তাদেরকে তাদের গ্রামের তাল গাছ দেখানোর জন্য আঙ্গুল দিয়ে অ্যাপস পরিচালনা করে, জুম করার মাধ্যমে তাল গাছটা খুব কাছাকাছি নিয়ে আসলেন।

IMG_20200902_101129.jpg

ঠোটের কোনায় আনন্দের হাসি নিয়ে যখন ফাইনাল জুম করে ছবিটাকে স্পষ্ট করলেন, তখন শব্দ করে বাবলু সাহেবের সহকর্মী দুইজন হাসতে আরম্ভ করলেন, এতো দেখি ডিজিটাল তালগাছ বাবলু সাহেব। আপনার গ্রামের তালগাছ গুলোও দেখি ডিজিটাল হয়ে গেছে, আজ থেকে মোবাইল টাওয়ারের নতুন নাম রচনা করলেন আমাদের বাবলু সাহেব, "ডিজিটাল তালগাছ"।



0
0
0.000
5 comments
avatar

প্রথমাংশের আন্তর্জাতিক নারী শক্তি দ্বারা ঘোষিত আইনটি ও শেষাংশ টি যদিও হাস্যরসাত্মক তাও গল্পটিতে বাবলু সাহেবের নিজ জন্মভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা আমরা সকলের মাঝেই কাম্য।

বরাবরের মতোই খুব ভালো লিখেছেন।একটা সোশ্যাল মেসেজ ফুটে উঠেছে।

0
0
0.000
avatar

This post earned a total payout of 0.174$ and 0.087$ worth of author reward that was liquified using @likwid.
Learn more.

0
0
0.000