শেষ বেলায় বৃদ্ধ্যাশ্রম!

বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি অভার ব্রীজের নিচে বসে লোকটা কি যেন বলে যায় একটানা বিরবির করে।
একটা ছেড়া শার্ট আর খুব পুরনো লুংগি পড়ে ঠিক সন্ধ্যার দিকে মাগরিবের আজানের পর বৃদ্ধ লোকটা এখানে এসে বসে পথের পানে চেয়ে থাকে।
হয়তো কারো অপেক্ষায়।
এখানে আমার সন্ধ্যার পর ডিউটি থাকে বিধায় দিনের বেলা আসা হয়ে ওঠেনা।
তবে কখনো কোনো জরুরি কাজে যদি আসিও লোকটা কে দেখিনা।
তার মানে সে শুধুই সন্ধ্যার পর এখানে আসে।
কারো কাছে সে কিছুই চায়না, এক ধ্যানে পথের দিকে চেয়ে থাকে আর কি যেন বিরবির করতে থাকে।
কেউ যদি মায়া করে দু চার পয়সা দান করে যায় তাও সে নেয়না।


pexels-guduru-ajay-bhargav-1043558.jpg


আমার খুব ইচ্ছে আমি তার খুব আপন হবো।
তার কাছে তার দুঃখের একটু খানি ভাগ চাইবো।
জানিনা সে দেবে কিনা!
তবে কোনো তো গল্প আছেই তার জিবনের ও।
একদিন ৫টার দিকে ডিউটি তে চলে যাই আমি।
ব্রীজের নিচে তাকিয়ে দেখি মানুষ টা নেই। থাকার কথাও না।
আমি জানি কখন আসবে।
মাগরিবের আজানের একটু পরেই।
নামাজ পড়ে এসেই তাকে দেখতে পেয়ে মনে মনে খুশি হই আমি।
আমি ভয়ে ভয়ে ২ কাপ কফি নিয়ে গিয়ে তার পাশে গিয়ে বসি।
তখনো সে পথের দিকে চেয়ে। আমি এক কাপ কফি আমার পাশের বৃদ্ধ লোক টার উদ্দেশ্যে আমার পাশে রেখে দিয়ে আরেক কাপ কফি তে একবার চুমুক দিয়ে তাকে জিগেস করলাম,
-কেমন আছেন চাচা?
লোকটা এবার আমাকে খেয়াল করলো।
হেসে বললো
-আলহামদুলিল্লাহ আপনি কেমন আছেন বাপজান?
আমার বিস্ময় এর সীমা ছাড়িয়ে গেলো।
এই লোকটা যাকে এতোদিন পাগল,উন্মাদ ভেবে এসেছে সবাই, এমনকি আমিও! সে কিনা এতো টা স্বাভাবিক!
আমি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও যেনো পারছিলাম না। বলে বসলাম
-আপনি কি সত্যিই ভালো আছেন চাচাজান?আমাকে বলুন না! আপনার কোনো উপকার হয়তো করতে পারবো না! হয়তো আপনার কোনো সমস্যারই সমাধান দিতে পারবোনা। কিন্তু আপনি হতেও তো পারেন খানিকটা হালকা! বলুন না চাচাজান? কি কষ্ট আপনার আমাকে বলুন? কার জন্য এখানে এভাবে আপনি বসে থাকেন?কার অপেক্ষায়?
লোকটা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকালো। আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম! সে চোখে যেন আগুন! টকটকে লাল রক্তের মতো রক্তিম!
তিনি সংগে সংগে উঠে চলে গেলেন।আমি আটকালাম না।সাহস পেলাম না আটকানোর।
সেদিন ডিউটি কম্পলিট না করেই চলে আসি।
পরদিন মাগরিব এর নামাজ পড়ে ব্রীজের নিচে গিয়ে বসলাম।
চাচাজান এর অপেক্ষায়।
চাচাজান আসলেন না।
৮টা পর্যন্ত বসে থেকে চলে আসলাম বাসায়।
এভাবে প্রায় একসপ্তাহ পার হয়ে যায়।
চাচাজান আসেন না।
এই ৭ টা দিন ই আমি চাচাজান এর অপেক্ষায় ব্রীজের নিচে বসেছিলাম।
আশা ছেড়েই দিয়ে ছিলাম।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো!
চাচাজান বুঝি আর আসবেন না!
অষ্টম দিন আমি সকালে ডিউটি তে গেলাম।
মশিউর ভাই ডেকে বললেন
-দেশের খবর কিছু রাখো না নাকি?
-কেন কি হয়েছে ভাই?
-আজ তো অবরোধ গাড়ি তো নাই!
-ওহ
ভুলেই গিয়েছিলাম অবরোধ এর কথা!
বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না বলে আজও চাচাজান এর জায়গাটা তে এসে বসলাম।
কিছুক্ষণ পর ই কে যেন কাধে হাত রাখলো আমার।
আমি চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক হলাম!
-চাচাজান!
-আমার ছেলের!
-আপনার ছেলের মানে?
-আমার ছেলের অপেক্ষায় থাকি আমি।
সে আসবে তো!
-কোথায় সে?
-বাড়িতে!
-আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা!
-বলছি, আগে আমাকে লেবু দিয়ে রঙ চা এনে দিতে পারো বাপ জান? ২ কাপ এনো। আজ তুমিও রঙ চা খাও! ওসব কফি টফি আমার সয় না!
আমি মুচকি হেসে চা নিয়ে এলাম।
-এবার বলুন চাচাজান!
-ছেলে টা আমার একদিন ইস্কুল থেকে কাদতে কাদতে বাড়ি এলো। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় ওকে কাদতে দেখলে! ওর মা মরেছে ওর জন্মের সময়ই। সেই থেকে ওকে মায়ের মমতা আর বাবার আদর দুটোই আমি দিয়েছি! ওকে জিগেস করে জানতে পারি ইস্কুলের মাষ্টার মশাই খুব মার মেরেছেন পড়া দিতে পারেনি বলে! এমতাবস্থায় অন্য কোনো বাবা হলে নিশ্চয় পড়া না পারার কারনে ছেলেকেই দোষারোপ করতো! কিন্তু আমি তা না করে সেই ইস্কুল থেকে ছেলেকে নিয়ে এসে অন্য ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম! যে ছেলেকে তার বাবা কোনোদিন মারেনি সেই ছেলেকে আরেকটা মানুষ কি করে মারে!


pexels-pixabay-220365.jpg


-ছেলে কে খুব ভালোবাসেন চাচা!
-তারপর শোনো! ছেলে টা আমার আস্তে আস্তে বড় হলো! ভার্সিটি লেভেল এ কোনো এক মেয়ের প্রেমে পড়লো! মেয়ে টাও আমার ছেলে টা কে ভালোবেসেছিলো।আমি খুশি হয়েছিলাম খুব। আমার ছেলে টা এবার আমি ছাড়াও অন্য এক মানুষ এর ভালোবাসা পাবে বলে।
আমি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম নিজেই বউমার বাড়িতে ওদের উভয়েরই পড়াশোনার শেষে!
ছেলে আমার মস্ত অফিসার বলে তারা বুঝে নিয়েছিলেন তাদের মেয়ের সুখের ঘাটতি হবেনা।
ওদের বিয়ে হয়েছিলো। বউমা প্রথম কয়েকদিন বেশ খেয়াল রাখতো আমার।
এতোটুকু বলে চাচাজান থেমে গেলেন।
আমি বুঝে নিয়েছিলাম কি হয়েছিলো পরবর্তী তে।
প্রসংগ পাল্টাতে আমি বললাম,
-চাচাজান, আপনি কি জানেন লেবু দিয়ে রঙ চা টা আমার কতো পছন্দ?
-বাপজান আমার ছেলের ও! আর আমার পছন্দ কড়া কফি!
আমি চাচাজান এর দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকালাম,
তা এড়িয়ে চাচাজান উঠে দাঁড়ালেন। পথের পানে চেয়ে গান ধরলেন,

" খোকার ও হয়েছে ছেলে
দু বছর হলো
তার তো মাত্র বছর পঁচিশ
ঠাকুর মুখ তোলো,
একশ বছর বাঁচবো আমি
এখন আমার সাধ!
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে ঊনষাট।
আশ্রমের এই ঘর টা ছোট জায়গা অনেক বেশি!
খোকা-আমি দুজনে তে থাকবো পাশাপাশি।
সেই দিন টার স্বপ্ন দেখি ভিষণ রকম!
মুখোমুখি আমি খোকা আর বৃদ্ধাশ্রম!

শেষের গানের লাইন ৪ টি বৃদ্ধ্যাশ্রম [ গায়ক : নচিকেতা] এর গান থেকে নেওয়া হয়েছে।

Pictures are taken from pexels.com



0
0
0.000
1 comments