ট্রয়লাসের চা

avatar
(Edited)

কিছুদিন আগেও ঠিক এই সময়টাতেই বাপ্পির টেবিলে ধূমায়িত একটি চায়ের কাপ পরে থাকতো। আপা প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে ওঠার সময় এই একটি বিষয় কখনই ভুলেনি। কারন, তিনিও জানতেন যে তার লেখক ছোট ভাইয়ের মাথা ঠিক কখন খোলতাই হত। বছরের পর বছর বাপ্পির এই সাহিত্যিক হবার আদিখ্যেতা অতি আদরের সাথে লাই দিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু এখন, আপাও নেই, এক কাপ চা বানিয়ে দেবার মত মানুষ ও নেই।

সাধারনত ঠিক চারটের সময় বাপ্পি ঘুমের থেকে উঠে পরে। দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ির কাটা থেকে ছড়িয়ে পড়া আবছা রেডিয়ামের আলোর দিকে তাকিয়ে আরো মিনিট পাচেক হয়ত কেটে যায়। তার পরপরই লাফিয়ে উঠে মুখ টুখ না ধুয়েই সটান ডায়েরি টা নিয়ে বসে যায় লিখতে। অনেকটা, সপ্নে পাওয়া ওষুধ এর মতন,আর এক্ষেত্রে তা হল সাহিত্য।

লোক প্রশাসনে পড়ে সাহিত্যিক! একথা শুনলেই আপার বান্ধবীরা প্রথমে বাপ্পির দিকে খানিক হা করে চেয়ে থাকতো। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলাবলি শুরু করে দিত। এ নিয়ে আপারও সময়ে সময়ে বাপ্পির উপর মেজাজ বেজায় গরম হয়ে যেত। কেন রে? তুই লেখক হতে চাস হবি! তা একটা বইও লিখে শেষ করতে পারলি না আগেই কেন এত আতেল এর মত করতে হবে! বাপ্পির কাছে এর উত্তর ছিল আরো সহজ, ভাব ছাড়া যে সাহিত্য হয় না!

Source

সে বছরই বাপ্পির আপা দেহত্যাগ করেন। ইহকুলে বাপ্পিকে সম্পুর্ন একা করে রেখে পা বাড়ালেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এমন এক স্থানের উদ্দেশ্যে, যাকে বাচ্চাদের ভুলিয়ে রাখার জন্যে বলা হয়ে থাকে বেহেশত তথা “নক্ষত্রলোক” । কিন্তু বাপ্পির মনে হয় সেখানে হয়ত অন্ধকার ব্যাতিত অন্য কিছু থাকে না।

তারপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, পলাশির মোড়, নীলক্ষেতের বই এর দোকান, আর মাঝেসাঝে ক্লাসের ফাকে মিথির সাথে লাজুক চোখাচোখি, এই করে কেটে যেত বাপ্পির ভোর থেকে সন্ধ্যা। আর সাথে প্রায় প্রার্থনার পর্যায় নিয়ে যাওয়া লিখালিখি।


আজকাল অনিন্দ আর সুদীপের কি যেন হয়েছে। তিনশ আটে ঢুকতে গেলেই কেমন ক্যাবলার মত করে দুজনেই একযোগে চেয়ে থাকে।

-- “আজকে কি হবে বন্ধুকূল? বং নাকি বাশি?”

উৎসাহিত চোখে সূদীপের ডলতে থাকা হাতের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে বাপ্পি।

-- “সে যেটাই হোক, তোর কপালে আজকে আর জুটবে না।“

-- “কেনরে? আমি আবার কি করলাম?”

বাপ্পির গলায় ঠাট্টার সূর অত্যধিক প্রবল। কিন্তু সূদীপের চোখ রাঙ্গানো দেখে খুব দ্রুত বেরিয়ে আসতে চাওয়া কথা গুলো বেচারাকে হজম করে ফেলতে হলো।

এবার অনিন্দ্যর মুখ খুলে গেল।

দেখ বাপ্পি। গত দুইবছর ধরে আমাদের সাথে তুই পাকু খাচ্ছিস। কিন্তু একদিন তো একটা পেপার ও কিনে এনে দিলি না। তাই আমরা দুজন ঠিক করেছি যে তোর সাথে আজকে থেকে আর কোন কানেকশন রাখবো না।

নীলক্ষেত থেকে ঝুম্পা লাহিড়ির দি লোল্যান্ড এর কপিটা কেনবার সময়ও এরকম কিছু হবে বুঝতে পারলে বাপ্পি টাকাগুলো ঠিক রেখে দিত। কিন্তু কোথাও কোন কিছু একটা গরবড় হয়ে গেছে। সূদীপ অনিন্দ্য দুজনেই বড়লোক বাপের সন্তান। টাকা নিয়ে ওদের এরকম কোন সমস্যা থাকবার কথা নয়।

-- শোন, তোর সামনে দুটি অপশান রেখে দিচ্ছি। যেকোন একটা করলেই তোকে আর টেনশান নিতে হবে না। গত দুবছরে সব হিসেবে নিয়ে পাকুর পেছনে আমাদের খরচ মোট বাষট্টী হাজার। তিন ভাগের হিসেবে তোর ভাগের টা দিয়ে দে। তোকে আর কিচ্ছু বলবো না। আর তা না পারলে মিথির সাথে ব্রেকাপ করে ফেল।

শেষ বাক্যটির ভাবার্থে বাপ্পির সামনে সব ঝকঝকে পরিষ্কার। প্রথম বর্ষে থাকতে মিথিকে যে অনিন্দ্যের মনে ধরেছে, একবার গাজার নেশায় সেটা বলে ফেলেছিল। এবং আজকের মুখ্য বিষয় ও সেটাই। ওরা দুজন জানে যে ডিপার্টমেন্টের স্টাইপেন্ড ছাড়া যার পেটে খাবার জোটে না, তারপক্ষে বিশটি হাজার টাকা যোগানো কোনভাবে সম্ভব না। তাই একবার বাজিয়ে দেখা আরকি।

-- মিথিকে তোর পছন্দ আগে বললি না কেন? এখন দুবছরের সম্পর্ক আমার পক্ষে ছেড়ে দেয়া অসম্ভব।

-- তাহলে টাকা দিয়ে দে?

-- একটু বোঝার চেষ্টা কর অনিন্দ্য। আমার অবস্থা তো তুই জানিস। হুট করে এত টাকা কোথায় পাবো বল?

-- আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না ! বাকি সব তোর ব্যপার ।

-- আর যদি না পারি?

মাথা ঠিক রাখতে না পেরে খিচিয়ে উঠলো বাপ্পি।

-- কি হবে দেখতেই পাবি ।

অনিন্দ্যের গলার স্বর হঠাৎই ভয়ঙ্কর শীতল হয়ে গেল। ক্রূর এক হাসি ফুটে উঠলো মুখে। ঊন্মাদের শব্দহীন হাসি, সাথে ঘোলাটে দৃষ্টি।

এরপর আর সেখানে থাকার সাহস হয়নি বাপ্পির। হেটে সোজা টিএসসির সামনের চায়ের দোকানগুলোতে চলে এসে এককাপ মাল্টা চায়ের অর্ডার দিয়ে দিল। চা খেতে খেতে ঠিক ও করে ফেললো যে, আজ থেকে সকল প্রকার নেশা বাদ। আপার চা যেখানে ছুটে গেছে, সেখানে একরত্তি গাজা কি আর বড় বেপার।


-- উপন্যাসের নাম কি ঠিক করলে? সাঝবিকেলে হাটতে বেরিয়ে মিথির প্রথম প্রশ্ন।

-- সে এখনো ঠিক করিনি। কিন্তু আমার ছদ্মনাম পেয়ে গেছি।

-- কি নাম? আর বাপ্পি কি দোষ করলো?

-- কোন ফেমাস রাইটারের নাম বাপ্পি শুনেছ কখনো?

শব্দ করে হেসে উঠে বাপ্পি। আর সে ঠেস লাগানো হাসিতে গা জলে যায় মিথির।

-- ধুৎ, তোমার সাথে আজকে বের হওয়াটাই ভুলে হয়ে গেছে। গেলাম আমি।

-- আরে দাড়াও! এখনো পাচ মিনিট ও তো হল না। নাম টা তো শুনে যাবে ?

রেগে গেলে মিথিকে অনেক সুন্দর লাগে। কিন্তু এভাবে হেটে চলে যাওয়া বাপ্পির কখনোই ভাল লাগে না। বেয়াড়া গ্রামোফোনের মত মহীনের ঘোড়াগুলির সিগনেচার গানটা মনে বাজতে থাকে। বোকা মেয়েটা যে “ট্রয়লাস” নামটাও শুনে গেল না, জেনেও গেল না যে আজকেই পাব্লিশারের হাতে এত সাধনার পান্ডুলিপিটা তুলে দিয়েছে, পরে ফেমাস হয়ে গেলে তো বিশ্বাস করতে চাইবে না যে এ বাপ্পির ই সাহিত্য।

আজকে পলাশির সোডিয়ামের আলোর নিচে হাটতে বেশ ভালই লাগছে। আবছা সবজেটে আলোয় হলুদ রঙের ছাই বর্ণ ধারণ করা, এসব খুটিনাটি বিষয় লক্ষ করাই তো একজন সাহিত্যিকের কাজ। যেমন, ওই যে ফুটপাতে বসে সিগেরেট টানছে একজন।

এতো দেখা যায় সূদীপ।

দীর্ঘ দুমাস পর আবার বন্ধুর চেহারা দেখতে পেয়ে বাপ্পির মনে হালকা একটি শান্তির আবেশ বয়ে গেল। এত দিনে মনে হয় সব ভুলে গেছে, এই চিন্তা করে জোরে ডাক দিয়ে উঠলো সে।

-- সূদীপ?

কিন্তু ওর হাতে ওটা কি চকচক করছে? কি হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বাপ্পি উলটো ঘুরে দোড় দিতে গেল। আর সাথে সাথে তলপেটে একটা গরম কিছুর ছোয়া। অনিন্দ্যের শেষ আলিঙ্গন।

জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে বাপ্পি বুঝতে পারলো যে, লাল রক্ত সোডিয়ামের নিচে কালো দেখা যায়। নিচের রাস্তার কালো পিচের সাথে যার রঙের কোন পার্থক্য নেই।




0
0
0.000
15 comments
avatar

The sad reality of the world of addiction, where no one is a "friend."

0
0
0.000
avatar

where no one is a "friend."

Aint that the truth. But the thing is, this is a world where most of the time the people you call friends are the ones giving and feeding you drugs. Too many cases but too little awareness..

0
0
0.000
avatar

Reminds me of something my father used tell me all the time :

A friend who offers you a cigarette is not a friend.

0
0
0.000
avatar

Wise words.. I see where you get your wisdom from bhai. :)

0
0
0.000
avatar

প্রতিটা মানুষের জীবনে হয়তো বা লুকিয়ে আছে কল রেকর্ড রহস্য।
কোনোটা অতীব আনন্দের আর কোন টা বেদনার

0
0
0.000
avatar

আনন্দের বা বেদনার রহস্য লুকিয়ে আছে সেটুকু সম্পুর্ণ সঠিক। কিন্তু কল রেকর্ড বলতে কি বুঝাতে চাইলেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না

0
0
0.000
avatar

Congratulations @zayedsakib! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You got more than 1250 replies. Your next target is to reach 1500 replies.

You can view your badges on your board And compare to others on the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

To support your work, I also upvoted your post!

Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!
0
0
0.000
avatar

ভাই ফিনিশিং টা এমন করলেন কেন 😞

0
0
0.000
avatar

মরে না গেলে বাপ্পি মন হয় ভালো বলতে পারতো :v

0
0
0.000
avatar

golper title ta odvhut sundor ..

0
0
0.000
avatar
(Edited)

Thank you xiba :). Golper title originally jake niye tar golpotao besh.. Mythology ar epics niye agroho thakle ektu trojan war niye ghete dekho.. Onek interesting kichu bishoy peye jabe :)

0
0
0.000
avatar

প্রানবন্ত ❤
ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় তাদের শেষ দেখা 😥

0
0
0.000
avatar

Something fate had decided for them eons ago. :)

0
0
0.000
avatar

Let’s flip it on its side :)

I will argue that we don’t understand our friends or enemies enough. Let me tell you the story of Narcissus :)

Narcissus was this beautiful man who used to go by a lake to look into his reflection everyday. One day he fell into the lake and died.

God of the forest who loved Narcissus stopped by the lake to find that the fresh water of the lake turned into salty water. The lake was crying over Narcissus. God said to the lake, oh it’s totally understandable to weep over Narcissus, as you must be fond of Narcissus’s beauty.

Lake said; really? Was Narcissus beautiful? God said; what are you talking about?! He came here everyday to sit by your bank looking into you! You should know all about his beauty.

Lake was silent for a while then said; I cry for Narcissus, but I never noticed that he was good looking. Each time he looked into me, I saw my own beauty reflected into his eyes...

0
0
0.000
avatar
(Edited)

AT LONG LAST DADA.. At last somebody who understands allegory. I was feeling so worthless up untill now.. Nobody seemed to even know who Troilus is!!

I will argue that we don’t understand our friends or enemies enough.

I agree a 100% Dada. Tragic tales of friendships are always either told by the victors or gods as narrators. Like, gods like to toy with humams a little too much, dont they?

I know a real life Anindo, the inspiration for my story. A Complex hearty guy living on impulses. Looks hearty when you are standing side by side, not on the flip.

But, if looked from different perspectives, any single object would always wield diffrent results, like Schroedingers Cat. what wouldve happened if মিথি/Cressida came or never left? What if Achilles fell at the hand of Troilus instead of the other way arround? Or if trojan war never happened? Or it was god of revenge instead of god of love. Too many parallel realities but no way to know being stuck inside this one.

I guss gods too learn a thing or two from their puny creations. Wouldve been quite the diffrent picture though if Narcissus looked at a river instead of a lake. Father wouldve saved his son, thats for sure.

0
0
0.000